রাষ্ট্রকূট রাজবংশ
অষ্টম শতাব্দীর মধ্যভাগে চালুক্য শক্তির পতনের পর দক্ষিণ ভারতে রাষ্ট্রকূটদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়। রাষ্ট্রকূটরা প্রায় দুই শতাব্দী ধরে (৭৫৩-৯৭৫ খ্রিস্টাব্দ) দাক্ষিণাত্যের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে আধিপত্য বজায় রেখেছিল। তাঁদের সাম্রাজ্য আধুনিক ভারতের সমগ্র কর্ণাটক রাজ্য বিস্তৃত ছিল এবং তামিলনাড়ু, অন্ধ্র প্রদেশ, তেলেঙ্গানা, মহারাষ্ট্র এবং গুজরাটের কিছু অংশকে অন্তর্ভুক্ত করেছিল।
◇ রাষ্ট্রকূটদের উৎপত্তি [ Origin of Rashtrakutas]
রাষ্ট্রকূটদের উৎপত্তি বা আদি বাসস্থান সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ আছে।
(১) নবম শতাব্দীর একটি রাষ্ট্রকূট অনুশাসন লিপিতে তাঁদের মহাভারতের বিখ্যাত যদু-বংশীয় বীর সাত্যকির বংশধর বলে বর্ণনা করা হয়েছে। রাষ্ট্রকূট রাজাদের সভাকবিরা রাষ্ট্রকূট-রাজ তৃতীয় গোবিন্দকে ভগবান কৃষ্ণ বলে বর্ণনা করেছেন।
(২) অনেকের মতে, সম্রাট অশোকের শিলালিপিতে বর্ণিত রথিক বা রাষ্ট্রীকরা হল রাষ্ট্রকূটদের পূর্বপুরুষ।
(৩) বার্নেলের মতে, রাষ্ট্রকূটরা ছিল অন্ধ্রদেশের তেলেগু রেড্ডি বা কৃষক সম্প্রদায়ভুক্ত।
(৪) অনন্ত আলতেকরের মতে, রাষ্ট্রকূটরা ছিলেন কর্ণাটকের অধিবাসী এবং তাঁদের মাতৃভাষা ছিল কানাড়ি।
(৫) ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার মতে, রাষ্ট্রকূট কথাটির অর্থ হল কোনো রাষ্ট্র বা প্রদেশের প্রধান। তাঁরা পঞ্চম শতাব্দী থেকে চালুক্য রাজাদের অধীনে দাক্ষিণাত্যের বিভিন্ন অঞ্চলে সামন্ত রাজা হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। চালুক্য শাসকদের দুর্বলতার সুযোগে খ্রিস্টীয় অষ্টম শতকে তাঁরা দাক্ষিণাত্যে স্বাধীন রাজবংশের প্রতিষ্ঠা করেন।
(৬) রাষ্ট্রকূট বংশের প্রথম উল্লেখযোগ্য শাসক ছিলেন ইন্দ্র, যিনি এক চালুক্য রাজকন্যাকে বিবাহ করেছিলেন। ইন্দ্রের পরবর্তী সময়ে সিংহাসনে বসেন তাঁর পুত্র দন্তিদুর্গ। দন্তিদুর্গের সময় থেকেই রাষ্ট্রকূটদের প্রকৃত উত্থান শুরু হয়।
◇ রাষ্ট্রকূট সাম্রাজ্যের উত্থান [Rise of Rashtrakuta Dynasty]
■ দন্তিদুর্গ: রাষ্ট্রকূট রাজবংশের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন দন্তিদুর্গ (৭৫৩-৭৫৮ খ্রীঃ)। তিনি চালুক্য রাজাদের অধীনস্থ সামন্তরাজা ছিলেন। ড. আলতেকরের মতে, দ্বিতীয় বিক্রমাদিত্যের সামন্ত হিসেবে পল্লবদের বিরুদ্ধে কাঞ্চী অভিযানে এবং আরবদের ভারত অভিযান প্রতিরোধে তিনি সক্রিয় সহায়তা করেছিলেন। তাঁর বীরত্বে মুগ্ধ হয়ে চালুক্য-রাজ দ্বিতীয় বিক্রমাদিত্য দন্তিদুর্গকে 'পৃথিবী বল্লভ' ও 'খড়ঙ্গাবলোক উপাধিতে ভূষিত করেন। দ্বিতীয় বিক্রমাদিত্যের মৃত্যুর পর (৭৪৬ খ্রিঃ) তিনি স্বাধীন রাজা হিসেবে রাজ্যজয় শুরু করেন এবং গুজরাট, মালব, মধ্যপ্রদেশ ও বেরার জয় করেন। তাঁর শক্তিবৃদ্ধিতে আতঙ্কিত চালুক্য-রাজ দ্বিতীয় কীর্তিবর্মন তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেন এবং খান্দেশের যুদ্ধে পরাজিত হন। এর ফলে মহারাষ্ট্রের উত্তর ভাগ দন্তিদুর্গের অধিকারে চলে আসে, বাতাপির চালুক্য বংশের অবসান ঘটে এবং ৭৫৩ খ্রিস্টাব্দে রাষ্ট্রকূট বংশ প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমানে শোলাপুরের নিকটে মালখড তিনি রাজধানী স্থাপন করেন ও 'মহারাজাধিরাজ' উপাধি গ্রহণ করেন।
■ প্রথম কৃষ্ণ: দন্তিদুর্গের মৃত্যুর পর তাঁর কাকা প্রথম কৃষ্ণ (৭৫৮-৭৭৩ খ্রিঃ) সিংহাসনে বসেন। তিনি চালুক্য-রাজ দ্বিতীয় কীর্তিবর্মনকে পরাজিত করে সমগ্র মহারাষ্ট্রে নিজ আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত করেন এবং বাতাপির চালুক্য বংশের পতন ঘটে (৭৬০ খ্রিঃ)। তিনি মহীশূরের গঙ্গরাজা ও বেঙ্গির পূর্ব চালুক্যদের পরাস্ত করেন। এর ফলে সমগ্র মহারাষ্ট্র এবং মধ্যপ্রদেশ রাষ্ট্রকূটদের দখলে আসে। তিনি ইলোরার বিখ্যাত শিবমন্দির—কৈলাস মন্দির নির্মাণ করেছিলেন। ইলোরার পাহাড় কেটে মন্দিরটি নির্মিত। মন্দিরগাত্র অপূর্ব ভাস্কর্যমণ্ডিত।
■ দ্বিতীয় গোবিন্দ: প্রথম কৃষ্ণের পর তাঁর পুত্র দ্বিতীয় গোবিন্দ সিংহাসনে বসেন (৭৭৩-৭৮০ খ্রীঃ)। তিনি ছিলেন ব্যভিচারী, আরামপ্রিয় ও অকর্মণ্য। তিনি কনিষ্ঠ ভ্রাতা প্রথম ধ্রুবের হাতে শাসনকার্যের ভার ন্যস্ত করে নিজে আমোদ-প্রমোদে ডুব দেন। ফলে প্রথম ধ্রুব ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে উঠতে থাকেন। ভীত দ্বিতীয় গোবিন্দ প্রথম ধ্রুবকে শাসনক্ষমতা থেকে বিচ্যুত করলে প্রথম ধ্রুব বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন ও ভ্রাতা দ্বিতীয় গোবিন্দকে পরাজিত করে সিংহাসন দখল করেন।
■ প্রথম ধ্রুব: সিংহাসনে বসেই প্রথম ধ্রুব (৭৮০-৭৯৩ খ্রীঃ) মহীশূরের গঙ্গ-বংশীয় রাজা, বেঙ্গির চালুক্যরাজ ও পল্লবরাজ দন্তিবর্মনকে পরাজিত করে কাবেরী নদীর তীর পর্যন্ত সমগ্র দাক্ষিণাত্যে নিজ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করেন। দাক্ষিণাত্যে বিজয়ের পর তিনি আর্যাবর্তে সাম্রাজ্য বিস্তারে মনোযোগী হন, এর ফলে গুর্জর-প্রতিহার ও পাল রাজাদের সঙ্গে সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়। তিনি প্রতিহার-রাজ বৎসরাজ ও পালরাজা ধর্মপালকে পরাজিত করে গাঙ্গেয় উপত্যকায় আধিপত্য বিস্তার করে দাক্ষিণাত্যে ফিরে আসেন। তিনি ছিলেন রাষ্ট্রকূট বংশের প্রথম সার্বভৌম নরপতি। তিনি 'ধ্রুব নিরূপম', 'ধ্রুব ধারাবর্ষ', 'শ্রী বল্লভ' প্রভৃতি উপাধি গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর রাজত্বকালেই রাষ্ট্রকূট শক্তি প্রবল পরাক্রান্ত হয়ে ওঠে। তৃতীয় কৃষ্ণ তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র তৃতীয় গোবিন্দকে উত্তরাধিকারী হিসেবে মনোনীত করেছিলেন। একই সাথে, তিনি তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র স্তম্ভকে গঙ্গাদেবীর শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন।
■ তৃতীয় গোবিন্দ: রাষ্ট্রকূট রাজবংশের শ্রেষ্ঠ রাজা ছিলেন তৃতীয় গোবিন্দ (৭৯৩-৮১৪ খ্রীঃ)। পল্লব-বংশের রাজারা এবং গঙ্গবংশীয় যুবরাজ শিবরামের সহায়তায় গঙ্গাবেদীর শাসনকর্তা স্তম্ভ বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। তৃতীয় গোবিন্দ স্তম্ভকে পরাজিত করেন এবং শিবরামকে হত্যা করেন। তৃতীয় গোবিন্দ জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা স্তম্ভকে মুক্তি দেন এবং পুনরায় গঙ্গাবেদীর শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। এইভাবে নিজরাজ্যের মধ্যে অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ দমন করার পর তৃতীয় গোবিন্দ রাজ্যবিস্তারে মনোযোগী হন।
দাক্ষিণাত্যের পল্লবরাজ দন্তিবর্মন, বেঙ্গীরাজ চতুর্থ বিষ্ণুবর্মন তাঁর প্রভুত্ব স্বীকার করে নেন। এরপর তিনি উত্তর ভারতে রাজ্যবিস্তারে অগ্রসর হন। তিনি প্রতিহার-রাজ নাগভট্টকে পরাজিত করে উত্তর ভারতে প্রতিহার শক্তির আধিপত্যের সম্ভাবনা দূর করেন। বাংলার পালরাজা ধর্মপাল ও তাঁর প্রতিনিধি কনৌজের চক্রায়ুধ তাঁর আনুগত্য মেনে নেন। রাষ্ট্রকূট লিপি থেকে জানা যায় যে, তিনি উত্তর ভারতের আরও বহু রাজাকে পরাজিত করেন এবং হিমালয় পর্যন্ত রাজ্যবিস্তার করে ৮০০ খ্রিস্টাব্দে দাক্ষিণাত্যে ফিরে আসেন।
তৃতীয় গোবিন্দর উত্তর ভারতে রাজ্যবিস্তারের কালে বেঙ্গির চালুক্য-রাজ বিজয়াদিত্য বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। তিনি তাঁকে সিংহাসনচ্যুত করে তাঁর ভাই ভীমকে সিংহাসনে বসান। ইতিমধ্যে দাক্ষিণাত্যের গঙ্গ, পল্লব, চোল, পাণ্ড্য, কেরল প্রভৃতি রাজন্যবর্গ রাষ্ট্রকূট-বিরোধী শক্তিজোট গঠন করলে তিনি তাঁদের পরাজিত করেন এবং পল্লব রাজধানী কাঞ্চি দখল করেন। সিংহলের রাজাও তাঁর আনুগত্য মেনে নেন। তিনি প্রভুতবর্ষ, জগত্তুঙ্গা, অনুপমা, কীর্তিনারায়ণ, পৃথ্বীবল্লভ, শ্রীবল্লভ, বিমলাদিত্য, অতীশয়ধাবলা, ত্রিভুবনধাবল প্রভৃতি উপাধি গ্রহণ করেছিলেন।
■ প্রথম অমোঘবর্ষ: তৃতীয় গোবিন্দের মৃত্যুর পর তাঁর নাবালক পুত্র প্রথম অমোঘবর্ষ (৮১৪-৮৭৭ খ্রিঃ) সিংহাসনে বসেন। তিনি রাষ্ট্রকূট বংশের শ্রেষ্ঠ নরপতিদের অন্যতম ছিলেন। তিনি খুব শান্তিপ্রিয় রাজা ছিলেন। তিনি নাসিক থেকে মান্যখেটে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন। তিনি বেঙ্গির চালুক্যদের যুদ্ধে পরাজিত করেন, কিন্তু মহীশূরের গঙ্গ-রাজাদের বিরুদ্ধে দীর্ঘ কুড়ি বছর যুদ্ধ চালিয়েও ব্যর্থ হন। সামরিক দুর্বলতার জন্য তিনি উত্তর ভারতে ত্রিশক্তি সংগ্রামে অংশগ্রহণে সক্ষম হন নি।
তিনি সাহিত্য ও সংস্কৃতির উৎসাহী পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তাঁর রচিত 'রত্নমালিকা' ও 'কবিরাজমার্গ' সুধীজন-সমাদৃত কন্নড় ভাষায় দুটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। তিনি নিজে ব্রাহ্মণ্য-ধর্মাবলম্বী হলেও জৈন ধর্মের প্রতি তাঁর গভীর অনুরাগ ছিল। জৈন-পণ্ডিত জীনসেন এবং 'গণিতসার-সংগ্রহ' নামক গ্রন্থের লেখক মহাবিজয়াচার্য (শ্রীধর) তাঁর রাজসভায় অতিথি ছিলেন। জীনসেনের 'পার্শ্বঅভ্যুদয়' গ্রন্থটি তাঁরই পৃষ্ঠপোষকতায় রচিত হয়। আরব পর্যটক সুলেমানের মতে তিনি বিশ্বের চারজন শ্রেষ্ঠ রাজার অন্যতম ছিলেন। বাকি তিনজন হলেন চিনের সম্রাট, বাগদাদের খলিফা ও কনস্টান্টিনোপলের সুলতান।
■ দ্বিতীয় কৃষ্ণ: প্রথম অমোঘবর্ষের পর তাঁর পুত্র দ্বিতীয় কৃষ্ণ (৮৭৭-৯১৪ খ্রিঃ) সিংহাসনে বসেন। তিনি বেঙ্গির পূর্ব চালুক্যরাজ তৃতীয় বিজয়াদিত্যের উত্তরাধিকারী ভীমকে বন্দি করেন এবং সামন্ত হিসেবে থাকতে বাধ্য করেন। তাঁর রাজত্বকালে রাষ্ট্রকূটদের সঙ্গে প্রতিহার শক্তির দীর্ঘ প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলে। দ্বিতীয় কৃষ্ণ প্রতিহার-রাজ ভোজের কাছে পরাজিত হন। বৈবাহিক সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও দ্বিতীয় কৃষ্ণ চোল রাজ্য আক্রমণ করেন, কিন্তু যুদ্ধে পরাজিত হয়ে অপমানজনক সন্ধি স্বাক্ষরে বাধ্য হন। তিনি অকালবর্ষ ও শুভতুঙ্গা উপাধি গ্রহণ করেছিলেন।
■ তৃতীয় ইন্দ্র: দ্বিতীয় কৃষ্ণের মৃত্যুর পর তাঁর পৌত্র তৃতীয় ইন্দ্র (৯১৪-৯২৯ খ্রিঃ) সিংহাসনে বসেন। তিনি রাষ্ট্রকূট বংশের লুপ্ত গৌরব কিছুটা পুনরুদ্ধারে সক্ষম হন। তিনি প্রতিহার-রাজ মহীপালকে পরাজিত করে কনৌজ নগরী ধ্বংস করেন। দাক্ষিণাত্যে প্রত্যাবর্তনের পথে তিনি উজ্জয়িনী দখল করেন। দক্ষিণ ভারতে ফিরে তৃতীয় ইন্দ্র বেঙ্গীর চালুক্য-রাজ চতুর্থ বিজয়াদিত্যকে যুদ্ধে পরাজিত ও হত্যা করেন। তিনি কন্নড় কবি ও সেনাপতি শ্রী-বিজয়া এবং সংস্কৃত কবি ত্রিবিক্রমকে পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন। তিনি মধ্য ভারতের কালাচুরি রাজবংশের (চেদী) রাজকুমারী বিজম্বাকে বিয়ে করেছিলেন।
■ দুর্বল রাজন্যবর্গ: তৃতীয় ইন্দ্রের মৃত্যুর পর রাষ্ট্রকূট বংশের পতন ত্বরান্বিত হয়। তৃতীয় ইন্দ্রের পর সিংহাসনে বসেন তার পুত্র দ্বিতীয় অমোঘবর্ষ (৯২৯-৯৩০ খ্রিঃ), কিন্তু অনতিকালের মধ্যেই চতুর্থ গোবিন্দ (৯৩০-৯৩৬ খ্রিঃ) তাঁকে হত্যা করে সিংহাসন দখল করেন। চতুর্থ গোবিন্দের অত্যাচার প্রজাদের অতিষ্ঠ করে তোলে এবং ৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে চতুর্থ গোবিন্দের কাকা তৃতীয় অমোঘবর্ষ (৯৩৬-৯৪০ খ্রিঃ) চতুর্থ গোবিন্দকে ক্ষমতাচ্যুত করে শাসনভার গ্রহণ করেন। এঁরা সকলেই ছিলেন দুর্বল ও অকর্মণ্য।
■ তৃতীয় কৃষ্ণ: রাষ্ট্রকূট বংশের শেষ উল্লেখযোগ্য রাজা হলেন তৃতীয় কৃষ্ণ (৯৪০-৯৬৭ খ্রিঃ)। তিনি উত্তর ও দক্ষিণ ভারতে রাষ্ট্রকূট আধিপত্য বিস্তৃত করেন। তিনি মহীশূর পুনরায় জয় করেন। উত্তরে প্রতিহার-রাজ মহীপালকে পরাজিত করে তিনি কালাঞ্জর ও চিত্রকূট দখল করেন। গঙ্গাবেদীর শাসকের সহায়তায় তৃতীয় কৃষ্ণ চোলরাজ রাজাদিত্যকে পরাজিত করেন পল্লবদের রাজধানী কাঞ্চি ও চোল-নগরী তাঞ্জোর অধিকার করেন। তিনি কেরল ও পাণ্ড্যদের পরাজিত করে রামেশ্বর সেতুবন্ধে বিজয়স্তম্ভ প্রোথিত করেন। ৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে পুনরায় উত্তর ভারতে অভিযান চালিয়ে তিনি মালব, উজ্জয়িনী ও বুন্দেলখণ্ড জয় করেন। এমনকি সিংহলের রাজাও তাঁর বশ্যতা মেনে নেন। তিনি নিজেকে 'সকল দক্ষিণ দিগাধিপতি' বলে অভিহিত করেছেন।
◇ রাষ্ট্রকূট সাম্রাজ্যের পতন
তৃতীয় কৃষ্ণ দক্ষ শাসক হলেও, তাঁর অবিরাম যুদ্ধের ফলে দক্ষিণ ভারতের অনেক রাজ্য তাঁর শত্রুতে পরিণত হয়েছিল।। তাঁর মৃত্যুর পর, সাম্রাজ্যে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব প্রবল হয়ে ওঠে। পরমার শাসক সিয়ক এই অভ্যন্তরীণ দ্বন্দের সুযোগ নিয়ে রাষ্ট্রকূটদের রাজধানী মান্যখেট অধিকার করে লুটপাট চালান। চতুর্থ অমোঘবর্ষ বা খোট্টিগা (৯৬৭-৯৭২ খ্রিঃ) সিয়ককে বাধা দিতে গিয়ে মারা যান। এর ফলে রাষ্ট্রকূটদের কেন্দ্রীয় শক্তির দূর্বল হয়ে পড়ে এবং সামন্তরাজার বিদ্রোহ করে স্বাধীন হয়ে যায়। অবশেষে আনুমানিক ৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে কল্যাণীর চালুক্য-বংশীয় রাজা দ্বিতীয় তৈল রাষ্ট্রকূট রাজা দ্বিতীয় কার্ককে পরাজিত করে রাষ্ট্রকূট সাম্রাজ্যের অবসান ঘটান। রাষ্ট্রকূট বংশের শেষ রাজা চতুর্থ ইন্দ্র (৯৭৩-৯৮২ খ্রিঃ) শ্রাবণবেলগোলায় সাল্লেখনার মাধ্যমে মৃত্যুবরণ করলে, রাষ্ট্রকূটদের রাজবংশ বিলুপ্ত হয়ে যায়।
◇ রাষ্ট্রকূট বংশের তালিকা
রাষ্ট্রকূট রাজবংশের তালিকা নিম্নরূপঃ
- দন্তিদুর্গ (৭৫৩-৭৫৮ খ্রীঃ)
- প্রথম কৃষ্ণ (৭৫৮-৭৭৩ খ্রীঃ)
- দ্বিতীয় গোবিন্দ (৭৭৩-৭৮০ খ্রীঃ)
- প্রথম ধ্রুব (৭৮০-৭৯৩ খ্রীঃ)
- তৃতীয় গোবিন্দ (৭৯৩-৮১৪ খ্রীঃ)
- প্রথম অমোঘবর্ষ (৮১৪-৮৭৭ খ্রিঃ)
- দ্বিতীয় কৃষ্ণ (৮৭৭-৯১৪ খ্রিঃ)
- তৃতীয় ইন্দ্র (৯১৪-৯২৯ খ্রিঃ)
- দ্বিতীয় অমোঘবর্ষ (৯২৯-৯৩০ খ্রিঃ)
- চতুর্থ গোবিন্দ (৯৩০-৯৩৬ খ্রিঃ)
- তৃতীয় অমোঘবর্ষ (৯৩৬-৯৪০ খ্রিঃ)
- তৃতীয় কৃষ্ণ (৯৪০-৯৬৭ খ্রিঃ)
- চতুর্থ অমোঘবর্ষ বা খোট্টিগা (৯৬৭-৯৭২ খ্রিঃ)
- দ্বিতীয় কার্ক (৯৭২-৯৭৩ খ্রিঃ)
- চতুর্থ ইন্দ্র (৯৭৩-৯৮২ খ্রিঃ)
◇ রাষ্ট্রকূট শাসনের গুরুত্ব
রাষ্ট্রকূট শাসকেরা দুশো বছরের অধিককাল ধরে দাক্ষিণাত্য শাসন করেছিলেন। রাষ্ট্রকূট রাজারা ধর্মের ব্যাপারে ছিলেন অত্যন্ত সহনশীল, তারা শৈব, বৈষ্ণব ও জৈন ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা করেন। প্রথম কৃষ্ণ ইলোরার সুবিখ্যাত কৈলাস মন্দিরটি নির্মাণ করেন, এটি হল উচ্চস্তরের স্থাপত্য শিল্পের এক নিদর্শন। রাষ্ট্রকূট রাজা প্রথম অমোঘবর্ষ শিল্প ও সাহিত্যের সমাদর করতেন। তাঁর রাজসভায় কয়েকজন বিখ্যাত লেখক ও বুদ্ধিজীবীরা স্থান পেয়েছিলেন। আদিপুরাণ-এর লেখক জীনসেন, গণিতসারসংগ্রহ-এর লেখক মহাবীরাচার্য এবং অমোঘবৃত্তি-র লেখক সকতায়ন তাঁর রাজসভা অলংকৃত করেন। রাজা প্রথম অমোঘবর্ষ কানাড়ি ভাষায় রচনা করেন বিখ্যাত কাব্যতত্ত্ব কবিরাজমার্গ।
রাষ্ট্রকুট রাজারা দক্ষ শাসক ছিলেন, তাঁরা দেশে শান্তি বজায় রাখেন, দেশের বাণিজ্য বৃদ্ধি পেয়েছিল। বাণিজ্যসূত্রে যেসব আরব পশ্চিম ভারতে এসেছিলেন তাঁরা রাষ্ট্রকূট রাজাদের ধর্মীয় সহনশীলতার কথা উল্লেখ করেছেন। তাঁরা জানিয়েছেন 'বলহরা' (বল্লভরাজা) হলেন ভারতের শ্রেষ্ঠ রাজা, দেশের আর সব রাজারা তাঁকে সম্মান করেন। তিনি সৈনিকদের নিয়মিত বেতন দেন, তাঁর অনেক হাতি ও ঘোড়া আছে, আছে অঢেল সম্পদ। তাঁর সৈন্য ও হাতির সংখ্যা অনেক, কিন্তু তাঁর সৈন্যদের বেশিরভাগ হলো পদাতিক কারণ তাঁর রাজ্যটি অবস্থিত পাহাড়ের মধ্যে। রাজা ও জনগণ মুসলমানদের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন, কয়েকজন মুসলমান গভর্নর হিসেবে নিযুক্ত হন। মাসুদি লিখেছেন যে সমগ্র ভারতবর্ষে রাজা 'বলহরার' মতো মুসলমানদের কেউ সম্মান করেন না, তাঁর রাজ্যে ইসলাম সুরক্ষিত ও সম্মানিত। এখানে মুসলমানদের প্রার্থনার জন্য মসজিদ আছে, সেখানে বহু মুসলমান সমবেত হয়ে দিনে পাঁচবার প্রার্থনা করে।
◇ রাষ্ট্রকূট শাসনব্যবস্থা
রাষ্ট্রকূট শাসনব্যবস্থার সর্বেসর্বা ছিলেন রাজা। রাষ্ট্রকূট-শাসনব্যবস্থায় রাজা ছিলেন সর্বোচ্চ প্রশাসক। তিনি প্রতিদিন রাজদরবারে উপস্থিত থেকে শাসনকার্য পরিচালনা করতেন। তাঁরা 'মহারাজাধিরাজ', 'পরমভট্টারক' প্রভৃতি উপাধি ধারণ করতেন। রাজা কর্তৃক মনোনীত মন্ত্রীগণ শাসনকার্যে সহায়তা করতেন। যুবরাজ ও অন্যান্য কুমারগণ গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক পদে নিযুক্ত হতেন। মন্ত্রীদের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, রাজস্বমন্ত্রী ছিলেন বিশেষ ক্ষমতাশালী।
রাষ্ট্রকূটশাসকদের প্রত্যক্ষ শাসিত অঞ্চলগুলি প্রদেশ, বিষয় ও ভুক্তি—এই তিনভাগে বিভক্ত ছিল। শাসনব্যবস্থার সর্বনিম্ন একক ছিল গ্রাম। প্রদেশ বা রাজ্যের শাসনকর্তাকে বলা হত 'রাষ্ট্রপতি'। নিজ এলাকায় আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখা, সামরিক-বাহিনীকে নিয়ন্ত্রিত করা প্রভৃতি কাজ রাষ্ট্রপতিকে করতে হত। বিষয়-এর প্রধান শাসককে বলা হত 'বিষয়পতি', গ্রামগুলির শাসনের ভার ছিল গ্রাম-প্রধানের উপর। শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য গ্রাম-প্রধানের অধীনে একটি সুশিক্ষিত লাঠিয়াল-বাহিনী থাকত। গ্রাম-মহাজন' বা 'গ্রাম-মহাত্তার' নামক গ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিদের পরামর্শক্রমে গ্রাম-প্রধান গ্রাম-শাসন করতেন। গ্রামের অভ্যন্তরীণ উন্নয়নমূলক কাজও গ্রাম-প্রধানকে করতে হত।
রাষ্ট্রের আয়ের প্রধান উৎস ছিল ভূমি-রাজস্ব। উৎপন্ন ফসলের এক- চতুর্থাংশ কর হিসেবে গৃহীত হত। এছাড়া জলকর, খনিজ দ্রব্যের উপর কর প্রভৃতিও আদায় করা হত। দেশগ্রামুক্ত নামে রাজস্ব কর্মচারীদের উপর কর আদায়ের ভার ন্যস্ত থাকত। রাষ্ট্রকূট সাম্রাজ্যে সামন্তশাসনেরও অস্তিত্ব ছিল। শাসনতান্ত্রিক ব্যাপারে সামন্তরাজাগণ ছিলেন স্বাধীন। তাঁরা রাষ্ট্রকূটরাজাদের নিয়মিত কর দিতেন এবং যুদ্ধের সময় সেনাবাহিনী দিয়ে সাহায্য করতেন।
◇ উপসংহারঃ
দক্ষিণ ভারতে রাষ্ট্রকূট সাম্রাজ্যের উত্থান ঘটেছিল। তারা শুধুমাত্র দক্ষিণ ভারতেই নয়, উত্তর ভারতেও প্রভাব বিস্তার করেছিল। আরব ভ্রমণকারীদের বিবরণ থেকে জানা যায় যে, রাষ্ট্রকূট রাজারা তাদের সময়ের অন্যতম শক্তিশালী এবং প্রভাবশালী শাসক ছিলেন। আরব পর্যটক সুলেমান বলেছেন যে, প্রথম অমোঘবর্ষ ছিলেন ভারতের শ্রেষ্ঠ নরপতি এবং তিনি চীন সম্রাট, বাগদাদের খলিফা ও কনস্টানটিনোপোলের সম্রাটের সাথে তুলনা করেছেন।
Comments
Post a Comment