খেন রাজবংশ
খেন রাজবংশ (Khen dynasty) ছিল আদি মধ্যযুগে কামরূপ (আসাম) রাজ্যের একটি রাজবংশ। পাল রাজাদের পতনের পর 'খেন' বা 'কেন' নামে পরিচিত আদিম অধিবাসীদের একজন সর্দার কামরূপ রাজ্যের রাজা হয়েছিলেন। খেন রাজবংশের রাজধানী ছিল ধরলা নদীর বাম তীরে অবস্থিত কামতাপুর বা গোসানীমারী (বর্তমানে কোচবিহার জেলায়)।
খেন রাজবংশের উত্থান
খেনরা কোন্ জাতি ছিল, তা জানার কোনও নির্দিষ্ট উপায় নেই। খেন বংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন নীলধবজ (১৪৪০-১৪৬০ খ্রিঃ)। তিনি প্রথমে এক ব্রাহ্মণের বাড়িতে রাখালের কাজ করতেন। কামতা রাজ্যের শেষ রাজা মৃগাঙ্ককে (১৪১৫-১৪৪০ খ্রিঃ) সিংহাসনচ্যুত করার ক্ষেত্রে ওই ব্রাহ্মণ বিশেষ সাহায্য করেছিলেন। খেন সর্দার 'নীলধ্বজ' নামে হিন্দু উপাধি গ্রহণ করে কামরূপের রাজা হন এবং তাঁর প্রাক্তন মনিব ব্রাহ্মণকে প্রধানমন্ত্রীর পদে নিয়োগ করেন। অষ্টাদশ শতাব্দীর গোসানি মঙ্গল কাব্যে উল্লেখ করা হয়েছে যে কান্তনাথ নামে এক বালকই খেন শাসক নীলধ্বজ হয়েছিলেন।
নীলধ্বজের পরে তাঁর পুত্র চক্রধ্বজ (১৪৬০-১৪৮০ খ্রিঃ) সিংহাসন লাভ করেন। চক্রধ্বজের পরে তাঁর পুত্র নীলাম্বর (১৪৮০-১৪৯৮ খ্রিঃ) রাজা হন। নীলাম্বর ছিলেন খেন বংশের শেষ রাজা। নীলাম্বর তাঁর রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার জেলা, আসামের অবিভক্ত কামরূপ ও দরং জেলা, এবং বাংলাদেশের উত্তর ময়মনসিংহসহ দিনাজপুর জেলার পূর্ব অংশ অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। তাঁর রাজ্য সীমা পূর্ব দিকে বরনদী এবং পশ্চিমে করতোয়ার তীর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল। তিনি পথঘাটের উন্নতির জন্য বিশেষ পরিশ্রম করেছিলেন। তিনি রাজ্য জুড়ে সুন্দর সুন্দর পথ নির্মাণ করেছিলেন। নীলাম্বর ঘোড়াঘাট দুর্গ নির্মাণ করেন। কোচবিহার, রংপুর এবং বগুড়া জেলার মধ্যে তাঁর নির্মিত পথের চিহ্ন বিদ্যমান রয়েছে।
খেন রাজবংশের পতন
নীলাম্বর রাজার পতন সম্পর্কে অনেক কিংবদন্তী প্রচলিত আছে। কথিত আছে যে, নীলাম্বরের পুত্র বিবিধ অসদাচরণে প্রবৃত্ত হন, এতে তিনি নিরতিশয় ক্রুদ্ধ হয়ে ব্রাহ্মণ মন্ত্রীদের প্রতি অত্যন্ত নিষ্ঠুর ব্যবহার করেছিলেন। মন্ত্রীগণ পলায়ন করে গৌড় নগরে গিয়ে নবাবের আশ্রয় গ্রহণ করেন। এই সময়ে আলাউদ্দিন হোসেন শাহ বাংলার নবাব ছিলেন। ব্রাহ্মণ মন্ত্রীরা হোসেন শাহকে কামরূপ আক্রমণ করতে উত্তেজিত ও প্ররোচিত করতে আরম্ভ করেন। হোসেন শাহ কামরূপ আক্রমণ করেন। নীলাম্বর অসাধারণ বীরত্বের সাথে তার আক্রমণ প্রতিরোধ করতে লাগলেন। বহু দীর্ঘ অবরোধের পর হোসেন শাহ ১৪৯৮ খ্রিস্টাব্দে কামরূপ অধিকার করেন।
বাংলার সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ কামরূপ রাজ্য শাসনের ভার তাঁর পুত্র দানিয়াল হোসেনের উপর অর্পণ করেছিলেন। সুলতান কামতাপুর বিজয়কে স্মরণীয় করে রাখার জন্য নিজের রাজধানী গৌড় বা মালদহে একটি মাদ্রাসা স্থাপন করেছিলেন। কিন্তু আলাউদ্দিন হোসেন শাহের পুত্র দানিয়াল হোসেন কামাতার রাজ্য শাসন করতে পারেননি। ১৫০৫ খ্রিস্টাব্দে হারুপ নারায়ণের নেতৃত্বে কামাতা অঞ্চলের অসমীয়া ভূঁইয়ারা শাহজাদা দানিয়াল হোসেন এবং তাঁর অফিসারদের আটক করে হত্যা করেন।
মুসলিম শাসনের অবসানের পর কামরূপ অনেক ক্ষুদ্র রাজ্যে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এই সময় কোচ উপজাতির হাজো নামে এক নেতার অধীনে বেশ কয়েকটি স্বাধীন উপজাতি একত্রিত হয়। হাজোর দুই কন্যা, হীরা ও জীরার বিয়ে হয় হারিয়া মেচ বা হারিয়া মণ্ডল নামে মেচ উপজাতির এক প্রতাপশালী যুবকের সঙ্গে। জীরার দুই পুত্র, মদন ও চন্দন, বর্তমান গোয়ালপাড়া জেলায় দক্ষতার সঙ্গে রাজত্ব করেন। ১৫০৯ খ্রিস্টাব্দে কোচ বংশের হীরার পুত্র বিশ্বসিংহ বারো ভূঁইয়াদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে বরনদীর পশ্চিম তীর পর্যন্ত অধিকার করেন, এবং কামতা রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ কোচ রাজবংশের হাতে আসে।
Comments
Post a Comment