পশ্চিমবঙ্গের পৌরসভার গঠন ও কার্যাবলী

পশ্চিমবঙ্গের পৌরসভাগুলি (Municipality of West Bengal) স্থানীয় শাসন ও প্রশাসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তারা অত্যাবশ্যকীয় পরিষেবা প্রদান, অবকাঠামো উন্নয়ন, এবং তাদের নিজ নিজ এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য দায়ী। এখানে পশ্চিমবঙ্গের পৌরসভার গঠন এবং ক্ষমতা ও কার্যাবলী আলোচনা করা হল।

পশ্চিমবঙ্গের পৌরসভার গঠন

ছোটো শহরগুলির স্বায়ত্তশাসন পৌরসভার মাধ্যমে পরিচালিত হয়। পশ্চিমবঙ্গে কলকাতা, চন্দননগর, হাওড়া, আসানসোল, দুর্গাপুর, বিধাননগর ও শিলিগুড়ি—এই সাতটি বড়ো শহর ছাড়া অন্য শহরগুলির স্বায়ত্তশাসন পরিচালনার ক্ষমতা সংশ্লিষ্ট পৌরসভাগুলিকে দেওয়া হয়েছে।

পৌরসভার শ্রেণীবিভাগ: পশ্চিমবঙ্গ পৌর আইন (১৯৯৪) অনুযায়ী পৌরসভাগুলিকে ক, খ, গ, ঘ, ঙ—এই পাঁচটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছে। দু-লক্ষ বা তার অধিক অধিবাসী নিয়ে 'ক' শ্রেণির, দেড় লক্ষ থেকে অনধিক দু-লক্ষ অধিবাসী নিয়ে 'খ' শ্রেণির, পঁচাত্তর হাজার থেকে অনধিক দেড় লক্ষ অধিবাসী নিয়ে 'গ' শ্রেণির, পঁচিশ হাজার থেকে অনধিক পঁচাত্তর হাজার অধিবাসী নিয়ে 'ঘ' শ্রেণির এবং অনধিক পঁচিশ হাজার অধিবাসী নিয়ে 'ঙ' শ্রেণির পৌরসভা গঠিত হওয়ার কথা বলা হয়েছে।

সদস্যদের নির্বাচন ও আসন সংরক্ষণ: নতুন পৌর আইনে পৌর অঞ্চলগুলিকে কতকগুলি ওয়ার্ডে ভাগ করা হয়েছে। নতুন আইনে পৌরসভার সদস্যরা কাউন্সিলার নামে আখ্যায়িত হয়েছেন। সার্বিক প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে কাউন্সিলাররা নির্বাচিত হন। নতুন আইনে প্রতিটি পৌরসভার মোট জনসংখ্যার আনুপাতিক হার অনুযায়ী তপশিলি জাতি ও উপজাতিদের জন্য আসন সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ওইসব সংরক্ষিত আসনের অন্তত এক-তৃতীয়াংশ তপশিলি জাতি ও উপজাতির মহিলাদের জন্য করা হয়েছে। তা ছাড়া প্রতিটি পৌরসভার মোট আসন সংখ্যার অন্তত এক-তৃতীয়াংশ (তপশিলি জাতি ও উপজাতি মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত আসনসহ) মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত হয়েছে।

বিবিধ কর্তৃপক্ষ: নতুন আইনে পৌরসভার কাজকর্ম পরিচালনার জন্য তিনটি কর্তৃপক্ষ গঠন করা হয়েছে — (১) পৌরসভা, (২) সপরিষদ চেয়ারম্যান, এবং (৩) চেয়ারম্যান। পৌরসভা বলতে বোঝায় নির্বাচিত সব কাউন্সিলারবৃন্দ বা কাউন্সিলর বোর্ড। কাউন্সিলার পরিষদের কার্যকাল পাঁচ বছর। প্রথম অধিবেশনে পরিষদের সদস্যরা নিজেদের মধ্য থেকে একজনকে চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচন করেন। সপরিষদ চেয়ারম্যান পৌরসভার চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান এবং বিভিন্ন শ্রেণির পৌরসভার ক্ষেত্রে বিভিন্ন সংখ্যায় কাউন্সিলারদের নিয়ে গঠিত হয়। অন্যদিকে চেয়ারম্যান হলেন পৌরসভার প্রধান কার্যনির্বাহক। সমগ্র পৌর প্রশাসন তাঁর নিয়ন্ত্রণে থাকে। কাউন্সিলার পরিষদ এবং সপরিষদ চেয়ারম্যানের সভায় তিনি সভাপতিত্ব করেন। তাঁর কার্যকালের মেয়াদ পাঁচ বছর।

বিবিধ কমিটি: উপরিউক্ত তিনটি কর্তৃপক্ষ ছাড়াও ২০০২ সালে পশ্চিমবঙ্গ পৌর আইন (সংশোধনী) অনুসারে, পৌরসভাগুলির অধীনে ছয় ধরনের কমিটি গঠনের কথা উল্লেখ করা হয়। এগুলি হল— (১) বরো কমিটি, (২) ওয়ার্ড কমিটি, (৩) স্থায়ী কমিটি, (৪) ঐতিহ্য রক্ষণাবেক্ষণ কমিটি, (৫) বিশেষ কমিটি এবং (৬) যৌথ কমিটি।

বিবিধ আধিকারিক: পৌরসভায় একজন করে নির্বাহী আধিকারিক (Executive Officer), রাজস্ব আধিকারিক (Finance Officer), সচিব (Secretary), প্রধান করণিক (Head Clerk), প্রধান সহকারী (Head Assistant), বাস্তুকার (Engineer), অফিস তত্ত্বাবধায়ক (Office Superintendent), হিসাব পরীক্ষক (Accountant), স্বাস্থ্য আধিকারিক (Health Officer), জনস্বাস্থ্য পরিদর্শক (Sanitary Inspector) প্রভৃতি পদাধিকারী রয়েছেন।

পশ্চিমবঙ্গের পৌরসভার ক্ষমতা ও কার্যাবলি

পশ্চিমবঙ্গের পৌরসভার ক্ষমতা ও কার্যাবলিকে প্রধানত তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়, যথা — (১) বাধ্যতামূলক, (২) স্বেচ্ছাধীন এবং (৩) অর্পিত কার্যাবলি।

(১) বাধ্যতামূলক কার্যাবলি: বাধ্যতামূলক কার্যাবলির মধ্যে ৪টি প্রধান কাজ স্থান পেয়েছে। এগুলি হল—(i) প্রশাসনিক, (ii) উন্নয়নমূলক, (iii) পূর্ত এবং (iv) জনস্বাস্থ্য-সম্পর্কিত কাজ। পৌরসভার বাধ্যতামূলক কাজের তালিকায় যে ৪৯টি বিষয় রয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল — জল সরবরাহ, নর্দমা, পয়ঃপ্রণালী ও জল নিষ্কাশনের ব্যবস্থা, রাস্তাঘাট নির্মাণ, বস্তি উন্নয়ন, জন্মমৃত্যু নথিভুক্তকরণ, বেআইনি গৃহ নির্মাণ বন্ধ করা, পরিবেশদূষণ রোধ, সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ, জনগণের টাকা চুরি প্রভৃতি।

(২) স্বেচ্ছাধীন কার্যাবলি: স্বেচ্ছাধীন কার্যাবলির তালিকায় উল্লিখিত ৪১টি বিষয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল—পানীয় জল সরবরাহ, হাসপাতাল, দাতব্য চিকিৎসালয় প্রতিষ্ঠা ও সংরক্ষণ, পাঠাগার নির্মাণ, অনাথ ও গৃহহীনদের জন্য গৃহ নির্মাণ, ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পের বিকাশসাধন, সামাজিক শিক্ষাদান, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সময় ত্রাণকার্য পরিচালনা, জোচ্চুরি প্রভৃতি।

(৩) অর্পিত কার্যাবলি: অর্পিত কার্যাবলির তালিকায় উল্লিখিত ১৭টি বিষয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল—স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ, নগর পরিকল্পনা, অসামরিক প্রতিরক্ষা, ক্রীড়া ও যুবকল্যাণ, বনসৃজন  প্রভৃতি।

উপসংহার

পশ্চিমবঙ্গের পৌরসভাগুলির প্রধান সমস্যা হল আর্থিক সংকট। তবে ১৯৯৪ সালে পশ্চিমবঙ্গে পৌর আইন কার্যকর হওয়ার পরে পৌরসভার সমস্যাগুলির অনেকটা সমাধান সম্ভব হয়েছে। পৌরসভাগুলির হাতে অধিক ক্ষমতা তুলে দেওয়ার পাশাপাশি এই আইনে উন্নয়নের স্বার্থে জনকল্যাণসাধনের জন্য অধিক পরিমাণে অর্থসংগ্রহের ক্ষমতা পৌরসভাগুলিকে দেওয়া হয়েছে।

Comments

Popular posts from this blog

ভারতীয় সংবিধানের নির্দেশমূলক নীতি

উড্রো উইলসনের চোদ্দো দফা নীতি